খাদ্য ব্যবস্থার রূপান্তর কোন পথে?
ফরিদা আখতার || Saturday 19 August 2023 ||গত ২৪ থেকে ২৬ জুলাই ইতালির রোম শহরে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এফএওর সদরদপ্তরে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল খাদ্য ব্যবস্থা সম্মেলন +২। এফএওর সঙ্গে সহ-উদ্যোক্তা ছিল বিশ্ব খাদ্য সংস্থা ও ইফাদ। অংশগ্রহণ করেছিলেন বাংলাদেশসহ বিশ্বের ২০টি দেশের রাষ্ট্র-সরকারপ্রধানসহ ১৬০টি দেশ থেকে প্রায় দুই হাজার প্রতিনিধি। বাংলাদেশ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাকসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিনিধি দল অংশ নিয়েছে। আমি আগ্রহভরে খবরগুলো পত্রপত্রিকায় পাঠের চেষ্টা করেছি, কিন্তু খুব বেশি তথ্য পাইনি। জাতিসংঘের এ ধরনের সভা আমাদের দেশের মানুষের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। খাদ্য ব্যবস্থা নিয়ে কথা হচ্ছে। এর সঙ্গে আমাদের সবার জীবন যুক্ত। অথচ সম্মেলনে কী ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, তার কোনো তথ্য জনগণ তো নয়ই; এমনকি যারা এ বিষয়ে খোঁজখবর রাখতে চান তাদের কাছেও পৌঁছায় না। পত্রিকায় যে খবর আসে তা প্রধানমন্ত্রীর সফর সংক্রান্ত প্রতিবেদন হয়ে যায় এবং সেখানে ইতালিতে তাঁর রাজনৈতিক সভা, সংবর্ধনা ইত্যাদির খবরসহ থাকে। আরও দুঃখজনক, সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের জনগুরুত্বপূর্ণ সভায় যোগদানের আগে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিদের সঙ্গে কোনো প্রকার মতবিনিময় করা হয় না। ফিরে এসেও কোনো প্রকার তথ্য দেওয়া হয় না। কিন্তু এই সম্মেলনে সরকারপক্ষ থেকে যা বলা হয়েছে এবং সে সম্মেলনে যা সিদ্ধান্ত হয়েছে, তা বিশ্বের খাদ্যের ভোক্তা মানুষ বিশেষ করে কৃষকদের জন্য কী বার্তা দিচ্ছে, সেটা নিয়ে দরকারি আলোচনা হওয়া উচিত।
বাসসের খবরে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাঁচ দফা প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন। খাদ্য মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী-সচিব পর্যায়ের প্রতিনিধি বিভিন্ন সাইড ইভেন্টে তাদের অর্জনের কথা তুলে ধরেছেন। প্রধানমন্ত্রীর ৫ দফায় মূলত আধুনিক কৃষি এবং বিশেষ করে প্রযুক্তিনির্ভর করপোরেট কৃষির কথা বলা হয়েছে। কৃষকের অধিকারের কথা বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের কারও কারও উপস্থাপনায় পাওয়া যায়। ইউটিউবে পাওয়া সাইড ইভেন্টে প্রদত্ত বক্তব্য শুনে এমন ধারণা করছি। এর বাইরে যদি বলা হয়ে থাকে, তাহলে অবশ্যই ধন্যবাদ দেব।
এ কথা কেউ অস্বীকার করবে না, খাদ্য ব্যবস্থার রূপান্তর ঘটছে এবং এর প্রয়োজনও রয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ব্যবস্থা সম্মেলন +২ মূলত দুই বছর আগে অনুষ্ঠিত খাদ্য ব্যবস্থা শীর্ষক সম্মেলনে নেওয়া পদক্ষেপগুলোর অগ্রগতি বা স্টকটেকিংয়ের জন্যই ছিল। তাই এর প্রেক্ষাপট একটু দেখলে বুঝতে পারব খাদ্য ব্যবস্থা রূপান্তরের জন্য সম্মেলনে কারা বেশি সক্রিয় ছিলেন এবং খাদ্য ও কৃষি সংস্থা নিজেই কাদের নির্দেশনায় কাজ করছে। এসব দেখা এই কারণেও দরকার, বিশ্বের খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা কোন দিকে যাচ্ছে, তা নিয়ে বেশ বিতর্ক রয়েছে। একদিকে করপোরেট আধিপত্যের কৃষি, অন্যদিকে প্রাণবৈচিত্র্য ও কৃষকের অধিকারনির্ভর চাষাবাদ। গত ৫০ থেকে ৬০-এর দশকজুড়ে সবুজ বিপ্লব নামে রাসায়নিক সার, কীটনাশক, ভূগর্ভস্থ পানি তোলানির্ভর চাষাবাদ করে পরিবেশের যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে। জলবায়ু বিপর্যয়েরও অন্যতম কারণ ইন্ডাস্ট্রিয়াল কৃষি। বিশ্বব্যাংকের উন্নয়ন সহযোগিতার অংশ হিসেবে এ ধরনের কৃষির প্রবর্তন করা হয়েছিল বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল বিশ্বের অনেক দেশে। এখন সেই কৃষি আর পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাচ্ছে না। কৃষকরাও ক্রমবর্ধমান সার ও কীটনাশকের মূল্য, মাটির তলার পানির খরচ দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। সবুজ বিপ্লবের মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা বা চালের নিরাপত্তা অর্জিত হয়েছে দাবি করা হলেও অন্যান্য খাদ্য যেমন ডাল, তেল, সবজি চাষ ব্যাহত হয়েছে। কীটনাশক প্রয়োগে বাধাগ্রস্ত হয়েছে স্থানীয় জাতের মাছ, হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল পালন। অর্থাৎ খাদ্যের অন্য সব উৎস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বর্তমান এই রাসায়নিকনির্ভর খাদ্য ব্যবস্থা বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ক্ষুধা মেটাতে পারেনি। তার সঙ্গে যুক্ত হয়ছে জলবায়ু পরিবর্তন, কভিড মহামারি, যুদ্ধ ইত্যাদির প্রভাব। এসবের কারণে ৭৮ কোটি ৩০ লাখ মানুষ ক্ষুধার সম্মুখীন হচ্ছে, যা ২০১৯ সাল থেকে ১২ কোটি ২০ লাখ বেশি। এই তথ্য দিয়েছে স্টেট অব ফুড সিকিউরিটি অ্যান্ড নিউট্রিশন বিষয়ে ওয়ার্ল্ড রিপোর্ট।
শুধু তাই নয়, বিশ্বজুড়ে স্বাস্থ্যকর খাদ্যলাভের সক্ষমতা কমেছে। ২০২১ সালে ৩ দশমিক ১ বিলিয়ন কিংবা ৪১ শতাংশ লোক স্বাস্থ্যকর খাবার পেতে সক্ষম হয়নি। এই তথ্য খোদ এফএও দিয়েছে। অতএব, বিরাজমান খাদ্য ব্যবস্থা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের খাবার জোগান দিতে পারছে না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ক্ষুদ্র কৃষক যা উৎপাদন করছে, তা ধ্বংস করে ইন্ডাস্ট্রিয়াল খাদ্য উৎপাদনের যে উদ্যোগ চলছে, এটি এক বিরাট চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। তবুও এই ক্ষুদ্র কৃষক এখনও বিশ্বের খাদ্য জোগানদাতা; বড় বড় করপোরেশন নয়।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস তাঁর উদ্বোধনী ভাষণে এ বছর মে মাসে প্রকাশিত গ্লোবাল রিপোর্ট অন ফুড ক্রাইসিসের বরাতে জানান, ২০২২ সালে ২৫ কোটি ৮০ লাখ মানুষ তীব্র ক্ষুধার মধ্যে ছিল, যা ২০২১ ও ২০২০-এর পর থেকে ক্রমে বাড়ছে।
২০২১ সালে খাদ্য ও কৃষি সংস্থার যে শীর্ষ সম্মেলন হয়েছিল, তাতে যে ধরনের সমাধানের কথা বলা হচ্ছিল এবং প্রাইভেট সেক্টরের অংশগ্রহণ বাড়ানোর চেষ্টা চলছিল; করপোরেশনের এই আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রায় ৯ হাজার নারী-পুরুষ, কৃষক সংগঠন, আদিবাসী, তরুণরা প্রতিবাদ জানাতে এসেছিল। তারা তাদের সমাবেশের নাম দিয়েছিল পিপলস সামিট। এখানে তারা খাদ্য ও কৃষি সংস্থার কয়েকটি ধরনের ব্যর্থতার কথা তুলে ধরে। যেমন ক্ষুধা, জলবায়ু পরিবর্তন, করপোরেট মোকাবিলার প্রধান চালিকাশক্তি যারা, তাদের চিনতে ভুল করেছে। কৃষক, নারী, আদিবাসী গোষ্ঠী এরাই বিশ্বের খাদ্য ব্যবস্থার মূল চালিকাশক্তি। সামিটে তাদের উপেক্ষা করা হয়েছে।
জাতিসংঘের খাদ্য ব্যবস্থাপনা সম্মেলনে বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা - জাতিসংঘ
সামিটে যাদের সক্রিয় থাকার কথা, তারা হচ্ছে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি। এ ব্যবস্থাকে বলা হয় মাল্টিল্যাটারালিজম বা বহুপক্ষীয়তা। কিন্তু সামিটে করপোরেট নেটওয়ার্ক, দাতা গোষ্ঠী, কোম্পানি নিয়োজিত বুদ্ধিজীবীরা নতুন ধারণা নিয়ে এলেন। সেটা হচ্ছে মাল্টি-স্টেকহোল্ডারিজম বা বহু অংশীদারিত্ব। বহু অংশীদারিত্ব বলতে যাদের বোঝানো হয়েছে, নির্দিষ্ট দেশের প্রতিনিধির বাইরে বিভিন্ন কোম্পানির প্রতিনিধিরাও থাকতে পারবেন এবং এর জন্যই তাদের যত দেনদরবার করা হয়েছে। কৃষকদের মানবাধিকার প্রশ্নে এ সম্মেলন ব্যর্থ হয়েছে।
খাদ্য ব্যবস্থার রূপান্তর হতে হলে জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান যেমন কৃষি ও খাদ্য সংস্থা, বিশ্ব খাদ্য সংস্থাকে বর্তমান বিশ্বের নানা সমস্যা ও সংকটের শিকার মানুষ ও জনগোষ্ঠীর কথা শুনতে হবে। এ প্রতিষ্ঠানগুলো যদি আসলেই খাদ্য ব্যবস্থার রূপান্তর চায় তাহলে তাদের উচিত হবে মানুষের নিজস্ব উদ্যোগ, তাদের খাদ্য ব্যবস্থা ও মানবাধিকার রক্ষা করে এবং প্রকৃতি ও আমাদের পৃথিবীর যত্ন নিয়ে খাদ্য ব্যবস্থার রূপান্তর ঘটানো। তারা প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষার মাধ্যমে খাদ্য সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা ও নারীর প্রতি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবে। জলবায়ু পরিবর্তন, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার ইত্যাদি বাদ দিয়ে খাদ্য ব্যবস্থার কোনো রূপান্তর সম্ভব নয়।
খাদ্য ব্যবস্থায় মানুষের প্রয়োজন মেটানো এবং কৃষকের অধিকার রক্ষা করার কাজকে অগ্রাধিকার দেবে। আশা করছি, আমাদের দেশেও সেই আলোচনা শুরু হবে। কৃষকের কণ্ঠস্বর তাদের কানে পৌঁছাবে।
বিশেষ দ্রষ্টব্য
এই লেখাটি (সমকাল) ১৬ আগষ্ট, ২০২৩ তারিখে 'খাদ্য ব্যবস্থার রূপান্তর কোন পথে?' এই শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে।
ফরিদা আখতার: সভানেত্রী, নারীগ্রন্থ প্রবর্তনা